Chronic Conditions

পিঠের বাম পাশে ব্যথা কেন হয়?

পিঠের বাম পাশে ব্যথা – শুধুই ব্যথা নয়, জীবনযাপনকেও ব্যাহত করে। কাজে মন বসে না, ঘুম হয় না, দিনটাই খারাপ যায়। কিন্তু কেন হয় এই ব্যথা? পেশী টান, হার্নিয়েটেড ডিস্ক, কিডনি পাথর, এমনকি মেরুদণ্ডের সমস্যাও হতে পারে। আজ আমরা বিস্তারিত জানবো পিঠের বাম পাশে ব্যথার সাধারণ কারণ, কখন চিন্তা বাড়ানো উচিত, এবং কিভাবে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে পারেন।

পিঠের বাম পাশে ব্যথার কারণ

পিঠের বাম পাশে ব্যথার বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে, যা শারীরিক অবস্থার উপর নির্ভর করে ভিন্ন হতে পারে। এখানে কিছু সাধারণ কারণ এবং তাদের ব্যাখ্যা দেওয়া হলো:

মাসেল স্ট্রেইন (Muscle Strain):

মাংসপেশীতে টান লাগা বা আঘাত পেয়ে পিঠের বাম পাশে ব্যথা অনুভূত হতে পারে। এটি মূলত ঘটে যখন অতিরিক্ত ভারী কিছু উত্তোলন করা হয়, দীর্ঘ সময় এক জায়গায় বসে থাকা বা অস্বাস্থ্যকর ভঙ্গিতে কাজ করা হয়। টান লাগা পেশীতে সাধারণত তীব্র ব্যথা, অস্বস্তি এবং সীমিত গতিরোধ সৃষ্টি হয়। এই ধরনের ব্যথা সাধারণত কয়েক দিন পর সেরে যায়, তবে যদি অধিকাংশ সময় এটি পুনরায় ঘটে, তবে ফিজিওথেরাপি বা চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।

সমাধান:

  • প্রথমে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন এবং ব্যথার স্থানটিতে বরফ ব্যবহার করুন। শুরুর কয়েকদিন বরফ প্রয়োগ করলে প্রদাহ কমে আসে। পরবর্তীতে যদি পেশীতে শক্ত ভাব থেকে যায় বা আরাম প্রয়োজন হয়, তবে গরম সেঁক দেওয়া যেতে পারে। একটি হিটিং প্যাড বা হালকা গরম তোয়ালে ব্যবহার করে সেঁক দিলে পেশী শিথিল হয় এবং ব্যথা দ্রুত উপশম হয়।
  • মাংসপেশীর চাপ কমাতে হালকা স্ট্রেচিং ব্যায়াম করুন। উদাহরণস্বরূপ, ধীরে ধীরে পিঠ ও কোমর স্ট্রেচ করা যেতে পারে।
  • ব্যথা কমাতে ওষুধ যেমন পেইন রিলিভার বা অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি ড্রাগস সেবন করা যেতে পারে, তবে তা চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে করা উচিত।
  • যদি ব্যথা দীর্ঘস্থায়ী হয় বা চলাফেরায় অসুবিধা হয়, তবে ফিজিওথেরাপির সাহায্য নিন। পেশীকে শক্তিশালী ও নমনীয় করার জন্য বিশেষ ব্যায়ামের প্রয়োজন হতে পারে।

স্কোলিওসিস (Scoliosis):

মেরুদণ্ড যদি একপাশে বাঁকে যায়, তখন তাকে স্কোলিওসিস বলা হয়। এটি এমন একটি শারীরিক অবস্থা, যেখানে মেরুদণ্ড সোজা না হয়ে একপাশে বাঁকা হয়ে যায়। বিশেষ করে যখন মেরুদণ্ড বাঁ দিকে বাঁকে, তখন তাকে লিভোস্কোলিওসিস বলা হয়। এই ধরনের বাঁকানো মেরুদণ্ড পিঠের বাম দিকে ব্যথা সৃষ্টি করতে পারে, বিশেষ করে যদি স্কোলিওসিস গুরুতর পর্যায়ে চলে যায়। এটি সাধারণত দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা সৃষ্টি করতে পারে এবং পেশীর ওপর অতিরিক্ত চাপ ফেলে, যার ফলে চলাফেরা, বসা বা দাঁড়ানো কঠিন হয়ে পড়ে।

সমাধান:

  • প্রাথমিক অবস্থায় স্কোলিওসিস নির্ণয়ের জন্য এক্স-রে বা অন্যান্য স্ক্যান করাতে হবে।
  • নিয়মিত ফিজিওথেরাপির মাধ্যমে মেরুদণ্ডের নমনীয়তা বাড়ানো যায়।
  • গুরুতর অবস্থায় ব্যাক ব্রেস ব্যবহার করা হতে পারে, যা মেরুদণ্ডকে সঠিক অবস্থানে রাখতে সাহায্য করে।
  • খুব জটিল ক্ষেত্রে সার্জারির প্রয়োজন হতে পারে। চিকিৎসকের পরামর্শমতো নিয়মিত চেকআপ এবং ব্যায়াম চর্চা করাও গুরুত্বপূর্ণ।

স্পাইনাল স্টেনোসিস (Spinal Stenosis):

স্পাইনাল স্টেনোসিস হচ্ছে মেরুদণ্ডের ক্যানেলে চাপ সৃষ্টি হওয়া, যার ফলে নার্ভের ওপর চাপ পড়ে। এই অবস্থা সাধারণত ৪০ বছর বয়স বা তার বেশি বয়সীদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। মেরুদণ্ডের ক্যানেলের সংকোচনের কারণে নার্ভে চাপ পড়লে পিঠের বাম পাশে তীব্র ব্যথা, পা বা কোমর পর্যন্ত ঝিম ঝিম ভাব অনুভূত হতে পারে। এটি অল্প বয়সীদের জন্য একটি কমন সমস্যা না হলেও, বয়স্কদের মধ্যে এটি একটি প্রচলিত সমস্যা, যা চলাফেরায় বাধা সৃষ্টি করতে পারে।

সমাধান:

  • প্রাথমিকভাবে ফিজিক্যাল থেরাপি ও স্ট্রেচিং ব্যায়াম করা উচিত, যা পেশীর শক্তি বাড়ায় এবং নার্ভে চাপ কমায়।
  • ব্যথা কমাতে পেইন রিলিফ ওষুধ সেবন করা যেতে পারে।
  • গুরুতর অবস্থায় স্পাইনাল ডিকমপ্রেশন থেরাপি বা সার্জারি প্রয়োজন হতে পারে।
  • অতিরিক্ত ওজন কমানো এবং সঠিক ভঙ্গিতে বসা ও দাঁড়ানোর অভ্যাস গড়ে তোলাও এই সমস্যার সমাধানে সহায়ক।

হার্ট সমস্যা (Heart Issues):

কখনও কখনও পিঠের বাম পাশে ব্যথা হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ হতে পারে, বিশেষত যখন বুক ও বাহুর বাম পাশে হঠাৎ ব্যথা অনুভূত হয়। এই ধরনের ব্যথা সাধারণত চাপের মতো অনুভূত হয়, এবং তা বাম বাহু বা পিঠের একপাশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এর সঙ্গে যদি শ্বাসকষ্ট, ক্লান্তি, বা ঘাম ঝরানোর মতো উপসর্গ যুক্ত থাকে, তাহলে তা একটি হৃদরোগের সংকেত হতে পারে। এই অবস্থায় দ্রুত চিকিৎসকের সাহায্য নেয়া জরুরি, কারণ এটি জীবনঘাতী হতে পারে।

সমাধান:

  • এই ধরনের লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের সাহায্য নিন বা নিকটস্থ হাসপাতালে যান।
  • হার্টের সমস্যা এড়াতে স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলুন, যেমন কম চর্বিযুক্ত এবং লবণ কম থাকা খাবার খাওয়া।
  • নিয়মিত ব্যায়াম করুন, তবে অতিরিক্ত পরিশ্রম এড়িয়ে চলুন।
  • ধূমপান ও অ্যালকোহল পরিহার করুন এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখুন।

কিডনির সমস্যা (Kidney Issues):

কিডনিতে সংক্রমণ বা কিডনি পাথরের কারণে পিঠের বাম পাশে তীব্র ব্যথা হতে পারে। কিডনি পাথর যদি বাম কিডনিতে থাকে, তবে এটি বিশেষভাবে বাম পাশে তীব্র ব্যথা সৃষ্টি করতে পারে। কিডনির সংক্রমণের ক্ষেত্রে ব্যথা সাধারণত তীব্র হয়ে থাকে এবং এটি প্রস্রাবের সমস্যা, জ্বর বা বমি হওয়ার মতো উপসর্গের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। কিডনি পাথর একদিকে তীব্র ব্যথা সৃষ্টি করে, অন্যদিকে এটি দীর্ঘ সময় ধরে থাকলে কিডনির কার্যক্ষমতাও কমিয়ে দিতে পারে।

সমাধান:

  • ব্যথা নিয়ন্ত্রণে প্রচুর পানি পান করুন এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
  • সংক্রমণ থাকলে অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করতে হবে।
  • কিডনি পাথর থাকলে তা নির্ণয়ের জন্য আল্ট্রাসাউন্ড বা সিটি স্ক্যান করানো দরকার। বড় পাথরের ক্ষেত্রে লিথোট্রিপসি (পাথর ভাঙার প্রক্রিয়া) বা সার্জারি করা হতে পারে।

অস্টিওপোরোসিস (Osteoporosis):

অস্টিওপোরোসিস একটি এমন রোগ, যেখানে হাড়ের ঘনত্ব কমে যায় এবং হাড় দুর্বল হয়ে যায়। এটি সাধারণত বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘটে এবং হাড়ের ভাঙন বা ফ্র্যাকচার হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। যখন হাড় দুর্বল হয়ে যায়, তখন সামান্য চাপেও কশেরুকায় ফ্র্যাকচার হতে পারে, যা পিঠে তীব্র ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই অবস্থায় ব্যথা দীর্ঘমেয়াদী হতে পারে এবং চলাফেরায় কঠিনতা সৃষ্টি করতে পারে। প্রাথমিক স্তরে ব্যথা না-ও হতে পারে, কিন্তু দীর্ঘদিন পরে এটি গুরুতর হয়ে উঠতে পারে।

সমাধান:

  • ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া এবং নিয়মিত রোদে থাকা হাড়ের ঘনত্ব বাড়ায়।
  • হালকা ব্যায়াম যেমন যোগব্যায়াম এবং স্ট্রেচিং হাড়কে শক্তিশালী করতে সাহায্য করে।
  • গুরুতর ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ বা হাড়ের ভাঙন প্রতিরোধকারী থেরাপি নেওয়া উচিত।

ফাইব্রোমায়ালজিয়া (Fibromyalgia):

ফাইব্রোমায়ালজিয়া একটি দীর্ঘস্থায়ী ব্যথার অবস্থা, যেখানে সারা শরীরে স্থায়ী বা ঊর্ধ্বমুখী ব্যথা সৃষ্টি হয়। এটি পেশী, সংযোগস্থল এবং নরম টিস্যুতে ব্যথার সৃষ্টি করতে পারে, এবং বিশেষ করে পিঠেও এর প্রভাব পড়তে পারে। এই অবস্থায় শারীরিক ক্লান্তি, ঘুমের সমস্যা এবং মানসিক চাপও দেখা দিতে পারে। ফাইব্রোমায়ালজিয়া যেহেতু দীর্ঘস্থায়ী এবং পূর্ণাঙ্গ নিরাময় সম্ভব নয়, তাই এটির ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসকের সহায়তা প্রয়োজন, যাতে ব্যথা কমানো এবং জীবনযাত্রা উন্নত করা যায়।

সমাধান:

  • হালকা অ্যারোবিক ব্যায়াম, যেমন হাঁটা বা সাইক্লিং করুন।
  • মানসিক চাপ কমাতে মেডিটেশন বা যোগব্যায়াম অভ্যাস করুন।
  • ব্যথা নিয়ন্ত্রণে পেইন রিলিফ ওষুধ বা অ্যান্টি-ডিপ্রেসেন্ট গ্রহণ করা যেতে পারে, তবে তা চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে করতে হবে।
  • জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে সঠিক ঘুম এবং খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখুন।

উপসংহার

পিঠের বাম পাশে ব্যথা সহজে উপেক্ষা করার মতো নয়। কারণটা যাই হোক না কেন, একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। নিয়মিত ব্যায়াম, সঠিক ভঙ্গিতে বসা-দাঁড়ানো, ওজন নিয়ন্ত্রণ, সুষম খাদ্য – এইসবই পিঠের ব্যথা প্রতিরোধে সাহায্য করবে। এই লেখাটা শুধুমাত্র তথ্যের জন্য, চিকিৎসা পরামর্শ না। সুস্থ থাকুন, সুন্দর থাকুন!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *